Friday, 27 December 2013

জীবন থেকে নেয়া গল্প এটি

যে গল্পটি লিখছি , জীবন থেকে নেয়া গল্প এটি । রংপুর মেডিকেল কলেজের এক বড় আপু আমাদের পেজে মেসেজ করে তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক কালবৈশাখী ঝড়ের কথা আমাকে জানিয়েছেন এবং অনুরোধ করেছেন , আমি যাতে সেই ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখে আমাদের এই পেজে পোষ্ট করি ।

আপুর ঘটনা পড়ে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম । এইরকম অসংখ্য ঘটনা আমাদের সমাজে হরহামেশাই ঘটছে কিন্তু সেগুলো থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে । চলুন পড়ে নেয়া যাক , কি ঘটেছিলো সেই আপুর জীবনে । মনুষ্যত্বহীন নির্লজ্জ এক প্রতারকের প্রেম নামক অভিনয় শুধু সেই আপুর জীবনই তছনছ করে নি , এলোমেলো করেছে তৃতীয় আরেকজনের জীবনও ।

গল্পের প্রয়োজনে ধরে নেয়া যাক সেই আপুর নাম অনাহিতা ।

রংপুর মেডিকেলে ফোর্থ ইয়ারে পড়ত অনাহিতা ইয়াসমিন । হাসিখুশি এই মেয়েটার দিন কেটে যেত ক্লাস করে , বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করে , বান্ধবীদের সাথে শপিং করে আর পড়ন্ত বিকেলে হোস্টেলের ছাদে বসে সুনীলের কবিতা পড়ে । অনাহিতার প্রিয় কবির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । নিজেকে সুনীলের নায়িকা নীরা ভেবে কবিতার সরোবরে ডুবে যেত সে ......... কবিতা পড়তে পড়তে কখন যে চারপাশে হুট করে সন্ধ্যা নেমে যেত , অনাহিতা কখনো বুঝতে পারত না । পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে নীড়ে ফিরে যেত আর নিজের কল্পনার বায়োস্কপে নীরার প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নামত অনাহিতা ।

অনাহিতা হোস্টেলের চারতলার ৩০৫ নম্বর রুমে থাকত । দীপ্তি , সুমনা আর সাদিয়া নামের মেয়ে তিনটা তার রুমমেট । মেডিক্যালে একই ক্লাসে পড়ত তারা । গ্রুপ স্টাডি করে , হইহুল্লোর করে , এটা সেটা রান্না-বান্না করে , একজন আরেকজনের উকুন মেরে চার রুমমেটের দিন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল ।

রাত বারোটা বেজে যাওয়ার পর রুমের লাইট অফ করে চার বান্ধবী বিছানায় চলে যেত । কিন্তু সাথে সাথেই তারা ঘুমিয়ে পড়ত না । অনাহিতা ছাড়া বাকি তিনজন অনেক রাত পর্যন্ত তাদের বয়ফ্রেন্ডের সাথে মোবাইলে গল্প করত । এতই আস্তে গল্প করত যে তাদের এক হাত দূরে বসেও বোঝা যেত না তারা কি বলছে !

তিন বান্ধবীকে দিনের পর দিন এভাবে প্রেম করতে দেখে অনাহিতারও ইচ্ছে করত মেঘেররাজ্যের কোন এক অচেনা রাজকুমারের সাথে প্রেমের আকাশে ডানা মেলে উড়তে ।

অনাহিতারও ইচ্ছে করত , জ্যোৎস্নাস্নাত কোন গভীর রাতে জানালার পাশে বসে মোবাইল ফোনে ভীষণ রোমান্টিক কোন রহস্যময় মানবের ভরাট কণ্ঠ থেকে সুনীলের প্রেমের কবিতা শুনতে !

ক্লাসের কতো মেয়ে নিজ ক্লাসমেটদের সাথেই এনগেজড হয়ে গেল ! অথচ অনাহিতা পারলো না পছন্দের কোন ছেলের সাথে নিজের সম্পর্কটাকে ফ্রেন্ডশিপ থেকে প্রেমের পর্যায়ে নিতে ।

ক্লাসের কোন ছেলেকে যে অনাহিতার মনে ধরেনি তা নয় !

গোলগাল চেহারার ভীষণ আতেল টাইপের একটা ছেলে মিরাজ । অত্যধিক সরলতার জন্য লোকে তাকে হাবলু বলে ডাকত । অথচ এই সরলতার জন্যই মিরাজকে অনাহিতার ভালবাসতে ইচ্ছে করত । কিন্তু হাবলু বইয়ের পাতা থেকে কখনো চোখ উঠাত না । অনাহিতা নামের এক প্রেমপ্রার্থী নারী যে দু চোখ ভরা ভালবাসা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সেটা আতেল মিরাজ কখনো বুঝতে পারতো না ।

আয়নার দিকে তাকাতেই অনাহিতার মনে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি তৈরি হত ।

মনে মনে ভাবত সে , থ্যাবড়ানো না হয়ে তার নাকটা আরেকটু খাড়া হলে প্রকৃতির কি এমন ক্ষতি হত ?

চাকমাদের মত ছোট ছোট না হয়ে তার চোখজোড়া যদি একটু ডাগর ডাগর হত , তাহলে তাকে দেখতে কি সুন্দরীই না লাগত !

বুঝতে পারত সে ।
সৌন্দর্যে অপূর্ণতা আছে বলেই ব্যাচের কোন ছেলে তার সাথে যেচে এসে কথা বলেনি ।

চেহারায় হৃদয়ে কাঁপন ধরাবার মত সৌন্দর্য নেই বলেই এখনো পর্যন্ত কোন ছেলে তাকে প্রপোজ করেনি ।

কিন্তু , অনাহিতারও ইচ্ছে করত ।

স্বপ্নরাজ্যের অসম্ভব সুন্দর কোন রূপবান পুরুষের হৃদয়ের উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে ।

অলস বিকেলগুলোতে পার্কের এক কোণার বেঞ্চিতে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে জীবনের সমীকরন সাজাতে ।

বান্ধবীরা গভীর রাত পর্যন্ত তাদের প্রেমিকদের সাথে বিরামহীন কথা বলে যেত আর হাতে একমগ ব্লাক কফি নিয়ে অনাহিতা টেবিলল্যাম্পের আলোতে সুনীলের কবিতা পড়ে যেত ।

রাত বাড়ত ।
বারান্দায় এসে দাড়াত অনাহিতা ।
দক্ষিণের হু হু বাতাসে তার মাথার চুল এলোমেলো উড়ত ।
ঝিঝি পোকার অবিশ্রান্ত গুঞ্জনে চারপাশ কেমন যেন অপার্থিব হয়ে থাকত ।
দক্ষিণের ঝোপটার গুমোট বাঁধা অন্ধকারে হাজার জোনাকি যেন জরির মেলা বসাত । অন্যরকম এক ভালো লাগায় অনাহিতার ঠোটে নিজের অজান্তেই আবৃত হত সুনীলের কবিতা ।

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো ।

একদিন ফেসবুক ওপেন করতেই অনাহিতা দেখল মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ নামের এক ভীষণ সুদর্শন , স্মার্ট ছেলে তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে । সাতপাঁচ না ভেবেই অনাহিতা সেই ছেলের রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করলো । ছেলেটা দেখতে এতই সুদর্শন যে মোহগ্রস্ত হয়ে তার সবকয়টা ছবিতে অনাহিতা লাইক কমেন্ট করলো ।

কি শান্ত ছেলেটার মুখ !
কি গভীর ভালোবাসা ছেলেটার ওই দুই চোখে !

কিছুক্ষণ পরে অবাক হয়ে অনাহিতা লক্ষ্য করলো , ছেলেটা তাকে চ্যাটে নক করেছে । সারারাত ছেলেটার সাথে গল্প করলো সে । উত্তেজনায় অনাহিতার নাকমুখ লাল হয়ে গেল , আবেগে তার শরীর থরথর করে মৃদু কাঁপতে লাগলো । ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত শহিদুল্লাহর সাথে চ্যাট করলো সে । ফলশ্রুতিতে পরদিন তার ক্লাস মিস হল ।

এভাবে দিন গড়িয়ে সপ্তাহ যায় ।
সপ্তাহ গড়িয়ে মাস যায় ।

ফেসবুকের নীল-সাদা জগত ছেড়ে ওরা দুজন মোবাইল ফোনে ঘন্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে লাগলো ।

অনাহিতা জানতে পারলো , খুব গরীব ঘরের ছেলে শহিদুল্লাহ ।
মা-বাবা মরা এই সুদর্শন গরীব ছেলেটার জন্য অনাহিতার মনে ভালোবাসার এক গভীর আবেগ খেলে যেত ।

সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ৩৩ তম ব্যাচের ছেলে শহিদুল্লাহ ।
অনাহিতাকে সে জানালো , আদৃতা নামের এক মেয়ের সাথে তার একবছরের প্রেম ছিল । মেয়েতা তার সাথে বিট্রে করে আমেরিকা প্রবাসী এক ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে সেখানে চলে যায় ।

ব্যাপারটাকে অনাহিতা নরম্যালি নিল । শহিদুল্লাহর জন্য তার খুব মায়া হল ।

একদিন মোবাইলে অনাহিতাকে প্রপোজ করে ফেলল শহিদুল্লাহ । তার সাথে দেখা করার জন্য অনাহিতাকে প্রেসার দিতে লাগলো সে ।

আগে কখনো এইরকম কন্ডিশনে পড়েনি অনাহিতা । স্বাভাবিকভাবেই সে ভয় পেল । যতই মোবাইলে কথা বলুক না কেন ! সামনাসামনি দেখা করা মেয়েদের জন্য খুব কঠিন একটা কাজ ।

অনাহিতা তার বোনদের সাথে খুব ফ্রি । বোনদের সে শহিদুল্লাহর কথা জানালো । তাদের কথা মত অনাহিতা শহিদুল্লাহকে তাদের বাসায় আসার জন্য তাগাদা দিল ।

শহিদুল্লাহ আসলো ।
এইরকম অসম্ভব রূপবান এক তরুণকে দেখে অনাহিতার বোনেরা তাকে বিনাশর্তে পছন্দ করে ফেলল ।

ঠিক হল , অনাহিতার ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষার পর শহিদুল্লাহর সাথে তার বিয়ে হবে ।

এরপরে অনাহিতার জীবন বলতে শুধুই শহিদুল্লাহ ।
ক্লাসে তার কথা ভাবতে ভাবতে অনাহিতা আনমনা হয়ে যায় ।
ঘুমিয়ে শুধুই সে শহিদুল্লাহর স্বপ্ন দেখে ।
প্রেম নামের তার হৃদয়ে যে নির্জলা মরুভূমি ছিল , শহিদুল্লাহর স্পর্শে তা সবুজে ভরে গেল ।

সময় যায় ।
অনাহিতা দ্বিতীয় প্রফেশনাল পরীক্ষা দেয় ।
শহিদুল্লাহ ইন্টার্র্নি কমপ্লিট করে বি.সি.এস এ টিকে গেল ।
পিজিতে অর্থোপেডিক্সে এম.এস এও চ্যান্স পেল ।
আর ওইদিকে শহিদুল্লাহর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে অনাহিতা দোয়া করতে লাগলো ।

অনাহিতা থাকে রংপুরে আর শহিদুল্লাহ ঢাকায় । দুরুত্বের কারণে ৩-৪ মাস পরপর তাদের দেখা হত ।
চাতক যেমন বৃষ্টির আশায় আকাশে চেয়ে থাকে , শহিদুল্লাহর জন্য তেমনি অপেক্ষা করতো অনাহিতা ।

এম.এস হয়ে যাওয়ার পর শহিদুল্লাহ বদলে যেতে থাকে ।
অনাহিতাকে এ এভয়েড করতে শুরু করে ।
দেখা করবে বলেও দেখা করে না , ফোনে অনাহিতার সাথে সে খুব খারাপ ব্যবহার করতে থাকে ।

শহিদুল্লাহর এই অভাবনীয় পরিবর্তনে অনাহিতা অবাক হয় ।
নীরবে সে কাঁদে আর নামাজ পড়ে শহিদুল্লাহর জন্য দোয়া করে ।

কিছুদিন পর শহিদুল্লাহ অনাহিতাকে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে অনাহিতাকে বিয়ে করা সম্ভব না ।
আগের গার্লফ্রেন্ডের সাথে নাকি তার সব ঝামেলা মিটমাট হয়ে গেছে ।
এখন থেকে আদৃতার সাথেই নাকি রিলেশন কন্টিনিউ করবে শহিদুল্লাহ ।

একথা শোনার পর অনাহিতা প্রচণ্ড রকম ভেঙ্গে পড়ে । পড়াশোনায় সে আর মন বসাতে পারেনা । ঘুমের বড়ি খেয়ে একবার সুইসাইডের এটেমট ও নেয় সে ।

দুই মাস পর ফেসবুকে আদৃতার সাথে যোগাযোগ করার ট্রাই করে অনাহিতা । নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টের কথা মেসেজ করে আদৃতাকে জানায় সে ।
কিন্তু আদৃতার কাছ থেকে কোন রিপ্লাই আসে না ।

পনের দিন পর আদৃতা অনাহিতাকে রিপ্লাই দেয় । অনাহিতার ফোন নাম্বার নেয় সে । ফোনে কথা বলে অনাহিতা যা জানতে পারে তাতে সে প্রচন্ড রকম শকড হয় ।

আদৃতার সাথে কখনই নাকি শহিদুল্লাহর ব্রেকআপ হয়নি । বরং গত ৩৭ মাস তার সাথে লিভ টুগেদার করেছে শহিদুল্লাহ । তাদের মধ্যে নাকি অসংখ্য ফিজিক্যাল রিলেশনও হয়েছে । এমনকি আদৃতা নাকি ৩ মাসের এবরশনও করেছে ।

কিন্তু গত মাসে আদৃতাকে ছেড়ে শহিদুল্লাহ বড়োলোকের এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করা শুরু করে দিয়েছে ।

নিজের চেয়ে আদৃতা খুব ভয়াবহ কন্ডিশনে আছে এটা জেনে অনাহিতা সাহস খুঁজে পেল । বুঝতে পারলো , এই নরপিশাচের জন্য কেঁদে লাভ নেই । নিজের দুঃখ ভুলে অনাহিতা আদৃতাকে মেণ্টালি সাপোর্ট দিল । আদৃতার সাথে দেখা করে মেয়েটাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দিল । বোঝাল , জীবন এত ছোট না । সবার জীবনেই এমন এক্সিডেন্ট আসে ।

নিজের জীবনের কালো অধ্যায় ভুলে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে দিন কাটায় অনাহিতা ।

অসহায় গরীব রোগীদের ভালবেসেই সে সারাজীবন বাঁচতে চায় ।

কিন্তু মাঝে মাঝে গভীর রাতে কোন দুঃস্বপ্নে এখনো সে শহিদুল্লাহকে দেখে।
জীবনের প্রথম প্রেম দুঃস্বপ্ন হয়ে হলেও মানুষকে তাড়া করে ।

collected.....www.facebook.com/icbnet

0 comments: