সেই
সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হয়েছি, আর এখন বাজে রাত ১০ টা। মাত্র বাসায় ঢুকে
গোসল শেষ করেছি। শরীরে একটুও শক্তি নেই বসে ভাত খাওয়ার মতো তাই না খেয়েই
শুয়ে পড়লাম। আধঘন্টা শুয়ে থেকে মনে হলো আমি না উঠলেতো তিথিও না খেয়ে শুয়ে
পড়বে। তাই নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলাম, গিয়ে দেখি আজ
সব আমার পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে।১ মিনিটের জন্য চিন্তা করলাম আজ কি
কোনো স্পেশাল দিন আমাদের? নাহ, হয়তো আজ তিথির
মন খুব ভালো তাই এতো আয়োজন। ভাগ্য ভালো যে নিজে থেকে উঠে এসেছি না হলে আমি
টায়ার্ড ভেবে তিথিও ডাকতোনা আর নিজেও খেতোনা। তিথি মেয়েটা যে আমাকে কি রকম
ভালোবাসে আমি নিজেও মাঝে মাঝে বুঝতে পারিনা। মেয়েরা আসলেই খুব ভালোবাসতে
পারে। সব রুপেই তারা সমান ভাবে ভালোবাসা লুটিয়ে দিতে পারে।
আগামি সাপ্তাহে আমাদের বিয়ের এক বছর পুর্ন হবে। রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম, ওর সাথে আমার পরিচয়টা খুবই আশ্চর্য ভাবে হয়েছিলো। ফেসবুকে ও আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলো অনেক আগে থেকেই কিন্তু কখনো আমাদের কথা হয়নি চ্যাটে। মাঝে মাঝে আমি ওর ছবিতে বা স্ট্যাটাসে অথবা ও আমা্রগুলোতে লাইক দিতো। এটুকুই ছিলো আমাদের সম্পর্ক। আমার বি বি এ লাস্ট সেমিস্টার ফাইনাল এক্সামের কিছুদিন আগে আমার বন্ধু রনি আমার মেসে এলো কিছুদিন থাকবে বলে, আমিও ভাবলাম ভালোই হয়েছে ওর থেকে কিছু হেল্প পাওয়া যাবে। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এক্সামের সময় আমি আর কিছু নিয়ে চিন্তা করিনা। এইফাঁকে রনি নিজের ফেসবুকের সাথে আমারটাও চালাতে লাগল। দুদিন পর আমাকে তিথির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো আমার পরিচিতো কিনা? আমি বললাম না, তুই চাইলে কথা বলতে পারিস কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারিনি যে ও আমারটা থেকেই ইতিমধ্যে কথা শুরু করে দিয়েছে আমার নামেই।
একমাস পর আমার এক্সাম শেষ হলো ও আমাকে তখন সব কাহিনি খুলে বলল,
-দেখ দোস্ত, তিথি মেয়েটাতো আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
-আমি বললাম, ভালো কথা আর তুই?
-আমিও ওকে পছন্দ করি কিন্তু একটা প্রবলেম আছে তা হলো ও জানেনা আমি কে? ও জানে আমি ইফতি।
-কি বলছিস? তুই আমার নামে কথা বলেছিস কেনো?
-আমি ভাবলাম তোরটা থেকেতো এড করাই আছে তাই কথা বলতে সুবিধা হবে, পরে আমি ওকে সব জানিয়ে দিবো।
-কিন্তু তোর ছবি?
-ওটাও তোরই।
–তুইতো আমাকে জানে মেরেছিস। যা করেছিস করেছিস কিন্তু জলদি শেষ কর এই কাহিনি।
কথা শেষ করেই ও বের হয়ে গেলো ক্লাস আছে বলে। আমি ভাবলাম আজকে একটু শান্তিতে ঘুমাই। এক্সামের জন্য এ কয়দিন ঠিকমতো ঘুমও হয়নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম, মনে হয় অনেক্ষন ধরেই ফোনটা বেজে যাচ্ছিলো, ঘুমের কারনে শুনতে পাইনি। ঘুম থেকে সন্ধ্যায় উঠে দেখি ৭টা মিস কল রনির। ফোন ব্যাক করে জানলাম ওর দাদা খুব অসুস্থ, ও বাড়ি যাচ্ছে। আর আমাকে খুব করে বলল, তিথিকে কিছু না জানাতে, পারলে এই দু তিন দিন ওর নাম করেই কথা চালিয়ে যেতে। আমি মুখে জি আচ্ছা বললেও মনে কোনো ইচ্ছাই ছিলনা তিথির সাথে কথা বলার। দীর্ঘ দিন পর আজ রাতে ফেসবুকে বসলাম। বেশ কিছু নটিফিকেশন আর দুটা মেসেজ এসেছে। আগে মেসেজটা চেক করলাম, দেখি একটা রনির আর একটা তিথির। আগে রনিরটা খুললাম, তাতে লিখা প্লিজ তিথির সাথে একটু কথা বলিস, না হলে মেয়েটা খুব কস্ট পাবে।
তারপর তিথির মেসেজটা খুললাম। এই প্রথম নজর দিয়ে ওকে দেখলাম। আগে কখনো ওভাবে দেখাও হয়নি ওকে। মেয়েটা আসলেই সুন্দ্র, কেমন একটা মায়া আছে চেহারাতে, চোখজোড়া মনে হচ্ছে পানিতে টলটল করছে এই বুঝি কেঁদে দিবে। সুন্দর বলতে সাদা না কিন্তু খুব মায়াবি চেহারা। একটু হিংসাই হলো, ইসসস আগে কেনো এই নজরটা দেইনি। যাইহোক এখন আর সে চিন্তা করে লাভ নেই, এখন দেখি তাদের প্রেম কতদূর? হঠাৎ মনে হলো ওরা কি ফোনে কথা বলেনি? তাহলেতো আর আমকে উকিল ধরতে হতোনা। মেসেজ দেখতে দেখতে বুঝলাম, না ওরা এখনো ফোনে কথা বলেনি। ফোনে কথা হবে আরো দুমাস পর তিথির জন্মদিনের দিন, এটা তিথির আবদার। দেখাও হবে ওদিন, তার মানে ততোদিন তিথির আমার চেহারার মানুষটাকেই ভালোবাসবে। তিথির লিখাগুলো দেখে আমার একবার সন্দেহ হলো এটাকি আসলেই কোনো মেয়ে নাকি ফেক আইডি? কোনো মেয়ে কিভাবে একমাসেই একটা ছেলেকে এতো ভালবাসে? পুরো মেসেজ পড়া শেষ করে বুঝলাম, তিথি আমাকে অনেক আগে থেকেই চিনে আমার লিখাগুলো নাকি ওর খুব ভালো লাগে। আমার সব স্ট্যাটাসে ওর লাইক আছে। দু তিন দিন তিথির সাথে কথা চালালাম, মেয়েটা চেহারার মতোই মায়াবতি হবে, খুব মায়া নিয়ে কথা বলে। আমি আগে কখনো ওর সাথে কথা বলিনি তবুও কেমন মায়া লাগতে লাগল ওর জন্য।
এই তিন দিন রনির সাথে কোনো কথা হয়নি আমার, ভাবলাম আজকে একটু ফোন দিয়ে দেখি ওর দাদার কি অবস্থা? ফোন দিয়ে জানতে পারলাম গতকাল রাতে ওর দাদা মারা গেছে, ওর দাদার চার দিনের মিলাদ শেষ করে ও চলে আসবে। তারমানে আরো চারদিন তিথির মায়াজালে আটকে থাকতে হবে। তিথি AIUB তে ৫ম সেমিষ্টারে পড়ছে। আর এক্সাম শেষ বলে আমিও এখন ফ্রি তাই ওর ক্লাস টাইমের পর পুরো সন্ধ্যা কথা হয় ওর সাথে প্রায় রাত ১টা, ২টা পর্যন্ত। মেয়েটার সাথে কথা বলে বুঝলাম মেয়েটা খুব ভালো, রনির বাকি জীবনটা খুব সুখে কাটবে কিন্তু কে জানতো যে রনির কপালের সুখ আমার কপালে চলে আসবে? চারদিন পর রনি যখন ঢাকায় আসছিলো তখন ওর বাসের এক্সিডেন্ট হয়, রনিসহ বাসের বেশকিছু লোক গুরুতর আহত হয়। আমি বার বার রনিকে ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করছিলোনা। প্রায় দুঘন্টা পর ওর ফোন থেকে একটা লোক ফোন দিয়ে জানালো, ও হাসপাতালে আছে অবস্থা খুব খারাপ। যেখানে বাস এক্সিডেন্ট হলো সেটা আমার বাসা থেকে প্রায় দেড়ঘন্টার পথ, আমি তখনি বের হয়ে গেলাম কিন্তু গিয়ে শুধু রনির নিথর দেহ ছাড়া আর কিছুই পেলামনা। ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত ক্ষরন হয়েছে, তিন ব্যাগ রক্ত দিয়েও ওকে বাঁচাতে পারেনি ডাক্তাররা।
সাত দিনের মধ্যেই সব কেমন উলট পালট হয়ে গেলো আমাদের জীবনে। রনিকে একা কবরে শুইয়ে দিয়ে সবাই চলে এলাম। পরের দুইদিন রনির বাড়িতে থেকে তৃতীয় দিন আমি ঢাকা চলে আসি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম তিথির সাথে আর কথা বলবনা কারন এই দূর্ঘটনার কথা আমি ওকে জানাতে পারবোনা। এইভেবে পরের কয়েকটা দিন ফেসবুকেই ঢুকলামনা। চার পাঁচ দিন পর যখন গেলাম, তখন মনেহলো যদি আর দু একদিন না আসতাম তাহলে কি হতো কে যানে? এই কয়েকদিনে তিথি প্রতিদিন প্রতিবেলা আমাকে মেসেজ করেছে। বার বার করে লিখে রেখেছে আমি ফেসবুকে ঢুকেই যেনো ওকে ফোন দেই, নিচে ওর নাম্বারটাও দেয়া। আমি ভাবলাম ভালোই হয়েছে নাম্বারটা দিয়েছে। আজ ফোন করে সব বলে দিবো, আমি ওর সাথে কথা বলিনি, কথা বলেছে আমার বন্ধু রনি যে এখন আর বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। ভেবেই ফোন ডায়েল করলাম। ওপাশ থেকে একজন ফোন রিসিভ করলো কিন্তু একটা ছেলের কন্ঠ কি করব ভাবতে ভাবতেই তিথিকে চেয়ে বসলাম আর আমার নাম বললাম। ছেলেটি কথা না বাড়িয়ে ডেকে দিলো তিথিকে।
তিথি ফোন ধরলো কি ধরলোনা বুঝতে পারলামনা কিন্তু মনে হলো ফোনে কেউ একজন ফুপিয়ে কাঁদছে। দু একবার হ্যালো বলার পর কান্না জড়ানো একটা কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘আমি তোমার সাথে আজকেই দেখা করতে চাই বিকাল ৫টায়’ বলেই ফোন কেটে দিলো। আচ্ছা মেয়েতো বাবা কথা নেই বার্তা নেই ফোন কেটে দিলো, আমার কথাটাও শুনলোনা। যেভাবেই হোক তিথিকেতো জানাতেই হবে যে সে ইফতির সাথে না, রনির সাথে কথা বলেছে। বের হলাম বিকাল ৫টায় তিথির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি একদম কোনার টেবিলে একটা মেয়ে বসে আছে, চুলের জন্য আর কিছু বুঝা যাচ্ছেনা। কোমর পর্যন্ত চুল, বুঝে নিলাম এটাই তিথি। ওর সামনে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে মেয়েটার দিকে তাকালাম। গোলাপি রঙের একটা ড্রেস পড়া ছিলো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোমার? চোখ এতো ফোলা কেনো? তারপর ও আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,
‘দেখো ইফতি এতোদিন আমি তোমার সাথে যা কথা বলেছি তাতে এক ফোটাও মিথ্যে তুমি খুজে পাবেনা, আর তুমি যা বলেছো তাতেও কোনো মিথ্যা থাকার কথা না কারন তোমার সাথে কথা বলার অনেক আগে থেকেই আমরা একজন আরেকজনের ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলাম। সেখানে আমি তোমাকে যতোটুকু জেনেছি তুমি ঠিক তেমনই। তুমি জানো আমি তোমাকে কত খানি ভালোবাসি, আর তুমিও যে আমাকে ভালোবাসো তা অস্বীকার করবোনা আমি। তোমার মাঝে এমন অনেক কিছুই আমি দেখেছি যা থেকে বুঝেছি যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো’। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো তিথি। আমি কথা বলার কোনো ভাষা খুজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম।
আমাকে চুপ দেখেই হয়তো ও আবার শুরু করলো, ‘আমি তোমাকে যতোটুকু ভালোবাসি তাতে আমি আমার সারাজীবন তোমার সাথে কাটাতে পারবো। এখন তুমি চিন্তা করো তুমি পারবে কিনা’? আমি এখনো চুপ। কি বলতে আসলাম আর কি শুনে যাচ্ছি? কিভাবে এই মেয়েটাকে এতো কষ্ট দেই, আর যদি সত্যিটা চেপে যাই সেটাওতো মিথ্যাই হচ্ছে। ও কি বুঝলো আমি জানিনা। আমাকে বলল, ‘তুমি দুইদিন সময় নিয়ে আমকে তোমার ডিসিশন জা্নিও, ফোনে কথা হবে’ বলেই উঠে চলে গেলো। আমি ওভাবেই বসে রইলাম। চিন্তা করতে শুরু করলাম, মেয়েটা সব দিক দিয়েই পারফেক্ট কিন্তু আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। আমি এই মিথ্যা সম্পর্ক কিভাবে শুরু করব? আমি আমার মায়ের সাথে খুব ফ্রি ছিলাম তাই মাকে সব জানালাম। আমার মা বলল, একটা মিথ্যা যদি কোনো মেয়ের জীবন সুন্দর করতে পারে তাহলে সেটা ভুল হবেনা।
সবকিছু ভুলে নতুন করে কথা শুরু করলাম তিথির সাথে কিন্তু এখন আর ফেসবুকে না, এখন কথা হয় ফোনে। তিন মাস কথা বললাম এর মধ্যেই বেশকিছু যায়গায় সিভি দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ দিলাম কয়েকটা, ভাগ্যক্রমে একটা ভালো জব পেয়েও গেলাম। আর তাতেই আমার মা আমাকে পেয়ে বসলো, সে আর দেরি করতে চায়না এখনি তিথিকে বৌ করে ঘরে তুলতে চায়। দুপক্ষের সম্মতিতে খুব ধুমধাম করেই বিয়ে শেষ হলো। বিয়ের ঠিক পাঁচ দিন পরই আমি তিথিকে নিয়ে ঢাকা চলে আসলাম। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে শুরু করলাম আমাদের টোনাটুনির জীবন। তিথির ভালোবাসার কথা বলে আমি শেষ করতে পারবোনা কিন্তু যেহেতু আমি বিয়ের আগে ভালোবাসতে পারিনি তাই এখন আমার ভালোবাসা দেখে তিথি প্রায়ই বলে, বিয়ের আগেওতো তুমি আমাকে এতো ভালোবাসতে না এখন যতোটা বাসো। আমি হাসি আর বলি, তখনতো তুমি আমার বউ ছিলেনা।
তিথি আমার খুব যত্ন করে, আমিও খুব চেষ্টা করি কিন্তু অফিস করে আবার এম বি এ ক্লাস তারপর বাসায় এসে আর সময় পাই কই? তারপর ও ছুটির দিনগুলো খুব চেষ্টা করি দুজন একসাথে কাটাতে। প্রতিদিন সকালে যেমন তিথি আমার জন্য চা বানিয়ে আনে, আলতো করে আমার কপালে চুমু দিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গায় তেমনি ছুটির দিনগুলোতে আমিও ওর জন্য নিজ হাতে চা বানিয়ে ওর ঘুম ভাঙ্গাই আর বিকালে চা খেতে খেতে ওকে বলি তোমার জন্য কেনা শাড়িটার দাম যেমনই হোক ওটাতে আমার অফুরন্ত ভালবাসা মাখানো থাকবে হয়তবা খুব জমকালো চুড়ি কিনে দিতে পারবনা কিন্তু তোমার জন্য কেনা নাকফুলটা, চুড়িটা, আর তোমার প্রিয় চকলেট সব কিছুই আমার ভালবাসায় মাতানো থাকবে! সারাজীবন তোমাকে এভাবেই ভালোবেসে যাবো……
আগামি সাপ্তাহে আমাদের বিয়ের এক বছর পুর্ন হবে। রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম, ওর সাথে আমার পরিচয়টা খুবই আশ্চর্য ভাবে হয়েছিলো। ফেসবুকে ও আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলো অনেক আগে থেকেই কিন্তু কখনো আমাদের কথা হয়নি চ্যাটে। মাঝে মাঝে আমি ওর ছবিতে বা স্ট্যাটাসে অথবা ও আমা্রগুলোতে লাইক দিতো। এটুকুই ছিলো আমাদের সম্পর্ক। আমার বি বি এ লাস্ট সেমিস্টার ফাইনাল এক্সামের কিছুদিন আগে আমার বন্ধু রনি আমার মেসে এলো কিছুদিন থাকবে বলে, আমিও ভাবলাম ভালোই হয়েছে ওর থেকে কিছু হেল্প পাওয়া যাবে। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এক্সামের সময় আমি আর কিছু নিয়ে চিন্তা করিনা। এইফাঁকে রনি নিজের ফেসবুকের সাথে আমারটাও চালাতে লাগল। দুদিন পর আমাকে তিথির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো আমার পরিচিতো কিনা? আমি বললাম না, তুই চাইলে কথা বলতে পারিস কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারিনি যে ও আমারটা থেকেই ইতিমধ্যে কথা শুরু করে দিয়েছে আমার নামেই।
একমাস পর আমার এক্সাম শেষ হলো ও আমাকে তখন সব কাহিনি খুলে বলল,
-দেখ দোস্ত, তিথি মেয়েটাতো আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
-আমি বললাম, ভালো কথা আর তুই?
-আমিও ওকে পছন্দ করি কিন্তু একটা প্রবলেম আছে তা হলো ও জানেনা আমি কে? ও জানে আমি ইফতি।
-কি বলছিস? তুই আমার নামে কথা বলেছিস কেনো?
-আমি ভাবলাম তোরটা থেকেতো এড করাই আছে তাই কথা বলতে সুবিধা হবে, পরে আমি ওকে সব জানিয়ে দিবো।
-কিন্তু তোর ছবি?
-ওটাও তোরই।
–তুইতো আমাকে জানে মেরেছিস। যা করেছিস করেছিস কিন্তু জলদি শেষ কর এই কাহিনি।
কথা শেষ করেই ও বের হয়ে গেলো ক্লাস আছে বলে। আমি ভাবলাম আজকে একটু শান্তিতে ঘুমাই। এক্সামের জন্য এ কয়দিন ঠিকমতো ঘুমও হয়নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম, মনে হয় অনেক্ষন ধরেই ফোনটা বেজে যাচ্ছিলো, ঘুমের কারনে শুনতে পাইনি। ঘুম থেকে সন্ধ্যায় উঠে দেখি ৭টা মিস কল রনির। ফোন ব্যাক করে জানলাম ওর দাদা খুব অসুস্থ, ও বাড়ি যাচ্ছে। আর আমাকে খুব করে বলল, তিথিকে কিছু না জানাতে, পারলে এই দু তিন দিন ওর নাম করেই কথা চালিয়ে যেতে। আমি মুখে জি আচ্ছা বললেও মনে কোনো ইচ্ছাই ছিলনা তিথির সাথে কথা বলার। দীর্ঘ দিন পর আজ রাতে ফেসবুকে বসলাম। বেশ কিছু নটিফিকেশন আর দুটা মেসেজ এসেছে। আগে মেসেজটা চেক করলাম, দেখি একটা রনির আর একটা তিথির। আগে রনিরটা খুললাম, তাতে লিখা প্লিজ তিথির সাথে একটু কথা বলিস, না হলে মেয়েটা খুব কস্ট পাবে।
তারপর তিথির মেসেজটা খুললাম। এই প্রথম নজর দিয়ে ওকে দেখলাম। আগে কখনো ওভাবে দেখাও হয়নি ওকে। মেয়েটা আসলেই সুন্দ্র, কেমন একটা মায়া আছে চেহারাতে, চোখজোড়া মনে হচ্ছে পানিতে টলটল করছে এই বুঝি কেঁদে দিবে। সুন্দর বলতে সাদা না কিন্তু খুব মায়াবি চেহারা। একটু হিংসাই হলো, ইসসস আগে কেনো এই নজরটা দেইনি। যাইহোক এখন আর সে চিন্তা করে লাভ নেই, এখন দেখি তাদের প্রেম কতদূর? হঠাৎ মনে হলো ওরা কি ফোনে কথা বলেনি? তাহলেতো আর আমকে উকিল ধরতে হতোনা। মেসেজ দেখতে দেখতে বুঝলাম, না ওরা এখনো ফোনে কথা বলেনি। ফোনে কথা হবে আরো দুমাস পর তিথির জন্মদিনের দিন, এটা তিথির আবদার। দেখাও হবে ওদিন, তার মানে ততোদিন তিথির আমার চেহারার মানুষটাকেই ভালোবাসবে। তিথির লিখাগুলো দেখে আমার একবার সন্দেহ হলো এটাকি আসলেই কোনো মেয়ে নাকি ফেক আইডি? কোনো মেয়ে কিভাবে একমাসেই একটা ছেলেকে এতো ভালবাসে? পুরো মেসেজ পড়া শেষ করে বুঝলাম, তিথি আমাকে অনেক আগে থেকেই চিনে আমার লিখাগুলো নাকি ওর খুব ভালো লাগে। আমার সব স্ট্যাটাসে ওর লাইক আছে। দু তিন দিন তিথির সাথে কথা চালালাম, মেয়েটা চেহারার মতোই মায়াবতি হবে, খুব মায়া নিয়ে কথা বলে। আমি আগে কখনো ওর সাথে কথা বলিনি তবুও কেমন মায়া লাগতে লাগল ওর জন্য।
এই তিন দিন রনির সাথে কোনো কথা হয়নি আমার, ভাবলাম আজকে একটু ফোন দিয়ে দেখি ওর দাদার কি অবস্থা? ফোন দিয়ে জানতে পারলাম গতকাল রাতে ওর দাদা মারা গেছে, ওর দাদার চার দিনের মিলাদ শেষ করে ও চলে আসবে। তারমানে আরো চারদিন তিথির মায়াজালে আটকে থাকতে হবে। তিথি AIUB তে ৫ম সেমিষ্টারে পড়ছে। আর এক্সাম শেষ বলে আমিও এখন ফ্রি তাই ওর ক্লাস টাইমের পর পুরো সন্ধ্যা কথা হয় ওর সাথে প্রায় রাত ১টা, ২টা পর্যন্ত। মেয়েটার সাথে কথা বলে বুঝলাম মেয়েটা খুব ভালো, রনির বাকি জীবনটা খুব সুখে কাটবে কিন্তু কে জানতো যে রনির কপালের সুখ আমার কপালে চলে আসবে? চারদিন পর রনি যখন ঢাকায় আসছিলো তখন ওর বাসের এক্সিডেন্ট হয়, রনিসহ বাসের বেশকিছু লোক গুরুতর আহত হয়। আমি বার বার রনিকে ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করছিলোনা। প্রায় দুঘন্টা পর ওর ফোন থেকে একটা লোক ফোন দিয়ে জানালো, ও হাসপাতালে আছে অবস্থা খুব খারাপ। যেখানে বাস এক্সিডেন্ট হলো সেটা আমার বাসা থেকে প্রায় দেড়ঘন্টার পথ, আমি তখনি বের হয়ে গেলাম কিন্তু গিয়ে শুধু রনির নিথর দেহ ছাড়া আর কিছুই পেলামনা। ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত ক্ষরন হয়েছে, তিন ব্যাগ রক্ত দিয়েও ওকে বাঁচাতে পারেনি ডাক্তাররা।
সাত দিনের মধ্যেই সব কেমন উলট পালট হয়ে গেলো আমাদের জীবনে। রনিকে একা কবরে শুইয়ে দিয়ে সবাই চলে এলাম। পরের দুইদিন রনির বাড়িতে থেকে তৃতীয় দিন আমি ঢাকা চলে আসি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম তিথির সাথে আর কথা বলবনা কারন এই দূর্ঘটনার কথা আমি ওকে জানাতে পারবোনা। এইভেবে পরের কয়েকটা দিন ফেসবুকেই ঢুকলামনা। চার পাঁচ দিন পর যখন গেলাম, তখন মনেহলো যদি আর দু একদিন না আসতাম তাহলে কি হতো কে যানে? এই কয়েকদিনে তিথি প্রতিদিন প্রতিবেলা আমাকে মেসেজ করেছে। বার বার করে লিখে রেখেছে আমি ফেসবুকে ঢুকেই যেনো ওকে ফোন দেই, নিচে ওর নাম্বারটাও দেয়া। আমি ভাবলাম ভালোই হয়েছে নাম্বারটা দিয়েছে। আজ ফোন করে সব বলে দিবো, আমি ওর সাথে কথা বলিনি, কথা বলেছে আমার বন্ধু রনি যে এখন আর বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। ভেবেই ফোন ডায়েল করলাম। ওপাশ থেকে একজন ফোন রিসিভ করলো কিন্তু একটা ছেলের কন্ঠ কি করব ভাবতে ভাবতেই তিথিকে চেয়ে বসলাম আর আমার নাম বললাম। ছেলেটি কথা না বাড়িয়ে ডেকে দিলো তিথিকে।
তিথি ফোন ধরলো কি ধরলোনা বুঝতে পারলামনা কিন্তু মনে হলো ফোনে কেউ একজন ফুপিয়ে কাঁদছে। দু একবার হ্যালো বলার পর কান্না জড়ানো একটা কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘আমি তোমার সাথে আজকেই দেখা করতে চাই বিকাল ৫টায়’ বলেই ফোন কেটে দিলো। আচ্ছা মেয়েতো বাবা কথা নেই বার্তা নেই ফোন কেটে দিলো, আমার কথাটাও শুনলোনা। যেভাবেই হোক তিথিকেতো জানাতেই হবে যে সে ইফতির সাথে না, রনির সাথে কথা বলেছে। বের হলাম বিকাল ৫টায় তিথির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি একদম কোনার টেবিলে একটা মেয়ে বসে আছে, চুলের জন্য আর কিছু বুঝা যাচ্ছেনা। কোমর পর্যন্ত চুল, বুঝে নিলাম এটাই তিথি। ওর সামনে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে মেয়েটার দিকে তাকালাম। গোলাপি রঙের একটা ড্রেস পড়া ছিলো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোমার? চোখ এতো ফোলা কেনো? তারপর ও আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,
‘দেখো ইফতি এতোদিন আমি তোমার সাথে যা কথা বলেছি তাতে এক ফোটাও মিথ্যে তুমি খুজে পাবেনা, আর তুমি যা বলেছো তাতেও কোনো মিথ্যা থাকার কথা না কারন তোমার সাথে কথা বলার অনেক আগে থেকেই আমরা একজন আরেকজনের ফ্রেন্ডলিস্টে ছিলাম। সেখানে আমি তোমাকে যতোটুকু জেনেছি তুমি ঠিক তেমনই। তুমি জানো আমি তোমাকে কত খানি ভালোবাসি, আর তুমিও যে আমাকে ভালোবাসো তা অস্বীকার করবোনা আমি। তোমার মাঝে এমন অনেক কিছুই আমি দেখেছি যা থেকে বুঝেছি যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো’। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো তিথি। আমি কথা বলার কোনো ভাষা খুজে না পেয়ে চুপ করে রইলাম।
আমাকে চুপ দেখেই হয়তো ও আবার শুরু করলো, ‘আমি তোমাকে যতোটুকু ভালোবাসি তাতে আমি আমার সারাজীবন তোমার সাথে কাটাতে পারবো। এখন তুমি চিন্তা করো তুমি পারবে কিনা’? আমি এখনো চুপ। কি বলতে আসলাম আর কি শুনে যাচ্ছি? কিভাবে এই মেয়েটাকে এতো কষ্ট দেই, আর যদি সত্যিটা চেপে যাই সেটাওতো মিথ্যাই হচ্ছে। ও কি বুঝলো আমি জানিনা। আমাকে বলল, ‘তুমি দুইদিন সময় নিয়ে আমকে তোমার ডিসিশন জা্নিও, ফোনে কথা হবে’ বলেই উঠে চলে গেলো। আমি ওভাবেই বসে রইলাম। চিন্তা করতে শুরু করলাম, মেয়েটা সব দিক দিয়েই পারফেক্ট কিন্তু আমার বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড। আমি এই মিথ্যা সম্পর্ক কিভাবে শুরু করব? আমি আমার মায়ের সাথে খুব ফ্রি ছিলাম তাই মাকে সব জানালাম। আমার মা বলল, একটা মিথ্যা যদি কোনো মেয়ের জীবন সুন্দর করতে পারে তাহলে সেটা ভুল হবেনা।
সবকিছু ভুলে নতুন করে কথা শুরু করলাম তিথির সাথে কিন্তু এখন আর ফেসবুকে না, এখন কথা হয় ফোনে। তিন মাস কথা বললাম এর মধ্যেই বেশকিছু যায়গায় সিভি দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ দিলাম কয়েকটা, ভাগ্যক্রমে একটা ভালো জব পেয়েও গেলাম। আর তাতেই আমার মা আমাকে পেয়ে বসলো, সে আর দেরি করতে চায়না এখনি তিথিকে বৌ করে ঘরে তুলতে চায়। দুপক্ষের সম্মতিতে খুব ধুমধাম করেই বিয়ে শেষ হলো। বিয়ের ঠিক পাঁচ দিন পরই আমি তিথিকে নিয়ে ঢাকা চলে আসলাম। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে শুরু করলাম আমাদের টোনাটুনির জীবন। তিথির ভালোবাসার কথা বলে আমি শেষ করতে পারবোনা কিন্তু যেহেতু আমি বিয়ের আগে ভালোবাসতে পারিনি তাই এখন আমার ভালোবাসা দেখে তিথি প্রায়ই বলে, বিয়ের আগেওতো তুমি আমাকে এতো ভালোবাসতে না এখন যতোটা বাসো। আমি হাসি আর বলি, তখনতো তুমি আমার বউ ছিলেনা।
তিথি আমার খুব যত্ন করে, আমিও খুব চেষ্টা করি কিন্তু অফিস করে আবার এম বি এ ক্লাস তারপর বাসায় এসে আর সময় পাই কই? তারপর ও ছুটির দিনগুলো খুব চেষ্টা করি দুজন একসাথে কাটাতে। প্রতিদিন সকালে যেমন তিথি আমার জন্য চা বানিয়ে আনে, আলতো করে আমার কপালে চুমু দিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গায় তেমনি ছুটির দিনগুলোতে আমিও ওর জন্য নিজ হাতে চা বানিয়ে ওর ঘুম ভাঙ্গাই আর বিকালে চা খেতে খেতে ওকে বলি তোমার জন্য কেনা শাড়িটার দাম যেমনই হোক ওটাতে আমার অফুরন্ত ভালবাসা মাখানো থাকবে হয়তবা খুব জমকালো চুড়ি কিনে দিতে পারবনা কিন্তু তোমার জন্য কেনা নাকফুলটা, চুড়িটা, আর তোমার প্রিয় চকলেট সব কিছুই আমার ভালবাসায় মাতানো থাকবে! সারাজীবন তোমাকে এভাবেই ভালোবেসে যাবো……
collected...
www.facebook.com/icbnet
0 comments:
Post a Comment