Wednesday 5 March 2014

নির্বোধ ভালবাসার গল্প: কয়জনে পারে? -1 (সত্যকাহিনী)


(এই সিরিজের প্রতিটি গল্প সত্যকাহিনী; পাত্রপাত্রী বদলানো হয়েছে, আর সাথে প্রেজেন্টেশানেও একটু রোম্যান্টিক ভাব আনা হয়ে থাকতে পারে)
*****************************************************
ছেলেটির নাম দিলাম আজহার, আমরা ডাকব আজু বলে
মেয়েটি নবনী, মায়ামায়া চেহারা আর সি্নগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে সহজেই যেকারো নজর কাড়ে।
এবং খুবই বুদ্ধিমতি।

আজু ছিল আমাদের স্কুলের ফার্স্ট বয়। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত।
ক্লাসের অন্য যে ছেলেগুলো ভাল রেজালট করতে চাইত, তারা সবাই সবসময় সেকেন্ড হতে চাইত, কারণ আজুর অস্তিত্বের কারণে ফার্স্ট হওয়াটা সম্ভব ছিলনা।

ক্লাস ফোর পর্যন্ত আইডিয়াল স্কুলে ছেলে-মেয়ে একসাথে ক্লাস ছিল।
"তোরা ছেলে কেন?" অথবা "তোরা কেন মেয়ে" এই লেভেলের ঝগড়া নিয়েই ছেলেমেয়েদের সম্পর্কটা তৈরী হয়ে থাকে তখন।
সেটা ভাল না খারাপ, সে বিবেচনা করার জো নেই।

ক্লাস ফাইভে এসে ালাদা করে দেয়া হলো,
আমরা ছেলেরা দুপুর বারোটায় স্কুলে যাই,মেয়েরা সকালে।
1140এর দিকে ছুটি হয় ওদের।
ধীরে ধীরে 1140 এর আগের সময়টাকে কুয়াশাঘেরা প্রাচীরের মতো লাগে সব ছেলের কাছে, সাথে সাথে মেয়েদেরকেও।
হয়ত, অনেকে "ওরা মেয়ে কেন" সেইসব প্রশ্নের জবাবও আঁচ করতে পারে।
মেয়েরাও হয়ত আঁচ করা শুরু করে।

ক্লাস ফাইভ, সিক্স, সেভেন যায়।

ক্লাস এইটে এসে আবার বৃত্তির কোচিংটা যখন হয়,
তখন ছেলেমেয়ে একশিফটে ক্লাস শুরু করে।

আজুর গল্পটা সেই সময়ের।

একশিফটে ক্লাস হলেও ছেলেদের আর মেয়েদের পড়ানো হতো আলাদা রুমে ...
সিঁড়ি দিয়ে উঠলে প্রথমে ছেলেদের রূম, তারপর ফাঁকা একরূম, তারপর মেয়েদের ...
আরও কয়েকটা রূম পার হয়ে গেলে টয়লেট

কয়েকদিনের মাথায় দেখা গেল আমাদের আজুর টয়লেটে যাওয়া খুব বেড়ে গ্যাছে ...
আমরা টয়লেটে গেলেই দেখতাম ব্যাটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হয় চুল ঠিক করছে, না হয় দাড়ি গজাচ্ছে কিনা ঠিকমতো তা দেখছে, না হয় মুগ্ধভাবে নিজেকেই দেখছে।
প্রথমে সবাই ডায়বেটিস বলে খেপালামও, কিন্তু কিছুদিনবাদেই বুঝলাম ঘটনা ভিন্ন।
'বাব'ুর কুয়াশা প্রাচীর ভাঙার শখ হয়েছে, প্রাচীরের অন্যপাশে নবনীর ছায়া।

তখনও আমরা কেউ বুঝিনি কি গভীরভাবে আজু ভালবেসেছিল সেই নবনীকে!

ক্লাস নাইন-টেনে আজু স্কুলে চলে আসত সাড়ে এগারটার আগে, মেয়েদের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চানাচুর বা মুড়িভাজা খেত, আর অপেক্ষা করত কখন নবনী বের হবে।
নবনীও জানত ব্যাপারটা, মাঝেমাঝে তাকাত আজুর দিকে কিন্তু পাত্তা দিতনা।
হয়ত বিরক্তও হতো।

আজুর রেজালট খুব খারাপ হওয়া শুরু করল, পড়াশোনা ছেড়েই দিল বলতে গেলে।

ক্লাস টেনে উঠে সবাই প্রচুর প্রাইভেট পড়ে, ছাত্রছাত্রীদের দিনের বেশীরভাগ সময় কেটে যায় স্যারদের ঘরে ঘরে। আজু খোঁজ নিয়ে নিয়ে নবনী যেসব ব্যাচে পড়ত তার আগের বা পরের ব্যাচে ভর্তি হলো। স্যারদের বাসা পর্যন্ত আজুর ডিস্টার্বকরা শুরু হলো।

নবনীর নিরক্তিও চরমসীমায় চলে গেল, এবং সেটাই স্বাভাবিক।
আজুর মনটাকে কেউ বুঝলনা।
নবনীও না। আমরা বন্ধুবান্ধবরাও না।
আজুর রেজালট তখন খুবই খারাপ, নবনী ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড গার্ল।
আমরা ভাবতাম নবনী তো আর পাগলনা!!

বিরক্তি যখন চরমসীমায়, নবনী তখন স্যারদের কাছে বিচার নিয়ে গেল। সেটাও স্বাভাবিক।
স্যাররা অনেকদিন পর কিছু নিয়ে ব্যাস্ত থাকার সময় পেলেন।
স্যারদের কেউ আজুর মনের কথাগুলো জানতেও চাইলনা।
ঝাড়ি দেয়া হলো, ধুনো দেয়া হলো, টি.সি.র ভয় দেখানো হলো;
ফলাফল হলো, হতাশ আজু সিগারেট, মাদক, ফেন্সিডিলে ডুবে গেল।
তাও সে নবনীকে ভুলতে পারেনা,
ভুলতে না পারার ভুলেই মাঝেমাঝে বিরক্ত করে বসে।
নবনীর সামনেই 'আর করবোনা' বলে কান ধরে উঠেবসে মাফ চেয়ে আসে;
নেশার জগতে ঢোকে, আবরও বিরক্ত করে।
অদ্ভুত ও অসহ্য এক বৃত্তের পরিধি বেয়ে আজু ঘুরোঘুরি করে।

নবনীও বেশীদিন এই ব্যাড-সাইকলটা সহ্য করলনা ... আবারও নালিশ গেল ..
ফলাফল টি.সি. ...

আজুর এস.এস.সি পাশ করা হয়নি ...

1996 তে আজুর সাথে শেষ দেখা ... আমাকে বলল, "আচ্ছা দোস্ত, আমি যদি ব্যাবসা করে অনেক টাকার মালিক হই, তাহলে কি ইঞ্জিনিয়ার একটা মেয়ে আমাকে বিয়ে করবেনা?"
আমি ওর দিকে করুণার চোখে তাকাই;
মনে মনে ভাবি, 'ব্যাটা, গাধা!'
কিন্তু আসলে বুকটা ফেটে যায় ...
এত নিষ্পাপ-নির্বোধ ভালবাসা আমি কখনও দেখিনি।

বছর তিনেক আগে শুনলাম,
আজু সারাদিন গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকে ...
এর ওর কাছে চেয়ে পানটা-সিগারেটটা খায়, মাঝে মাঝে চাঁদাবাজিও করে।
আমরা বন্ধুরা ব্যাপারটা নিয়ে গল্প করছিলাম; সবাই বলছিল 'আহারে'।

আমি বললাম, 'আচ্ছা, আজুটা কি এখন ঐভাবে আয়না দেখে আর চুল ঠিক করে?'
একজন রসিকতা করে বলল, 'গিয়া দেখ জংপড়া একটা আয়না বালিশের পাশে রাখা আছে।'
কেউ কেউ হাসে, কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস!!

আমরা সবাই ভাবি, 'আহা, সেই ফার্স্টবয় আজুর জীবনটা এমন হয়ে গেল!!'

আচ্ছা! আজু কি ভাবে?

হয়ত মনে মনে ভাবে, 'এভাবে জীবনটা নষ্ট করলাম!!'

অথবা, কি জানি?
হয়ত গভীর রাতে পরম যত্নে জংপড়া আয়নাটা হাতে নিয়ে মরচের দাগের ফাঁকে ফাঁকে নিজের চেহারাটা দেখে, আর অদ্ভুত আনন্দের সাথে বলে উঠে, 'সাবাশ!!'

ঠিকই তো!!

কয়জনে পারে?

0 comments: